দৈনিকের সাহিত্যপাতাগুলো সপ্তাহান্তে হাজির হয় আল্লার খাস রহমত পাওয়া একগুচ্ছ মানুষের আসমানি বাণী নিয়া। আমি যা পড়ি তাতেই মুগ্ধ হই। বৃহস্পতি আর শুক্কুরবারে ঘুরে ঘুরে দেয়ালে টানানো পত্রিকার সাহিত্যপাতা পড়ি। সাহিত্য ‘করে’ – এ রকম কাউকে চিনি না বলে, পত্রিকার পাতা থেকেই একটা ধারণা নিজের মতো বানিয়ে লওয়ার চেষ্টা করি।
এ সময় মান্নান সৈয়দরে পেয়ে যাই হাতের কাছে। আমি যেমন বাচবিচারহীনভাবে যা-তা পড়ি, মান্নানও তেমনি লেখেন বাচবিচারহীনভাবে – প্রায় সব পত্রিকায়, সাহিত্যের প্রায় সকল বিষয় নিয়া। আমার ভালো লাগে। লাগতে থাকে। একটা সময়ে সেই সব পত্রিকাই আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে, যেগুলা মান্নানের লেখা ছাপে। তৈরি হয় মুগ্ধতা, মোহাবেশ।
অবস্থা এমন দাঁড়িয়ে গিয়েছিল যে, মান্নান সৈয়দকে দেখার লোভে আমি হাজির হয়েছি খ্যাত-অখ্যাত বহু সাহিত্যসভায়। বেটাও একখান। উঁচা-লম্বা। সুপুরুষ। লম্বা চুল। চকচকে জামাকাপড়। পরে তারএক গল্প পড়েছিলাম। সম্ভবত সিলেটে মাস্টারির অভিজ্ঞতা নিয়া লেখা। লিখেছেন, রীতিমত কলেজ-পড়ুয়া ছাত্রছাত্রীদের সাথে পাল্লা দিয়া তিনি – ঐ তরুণ শিক্ষক – কাপড়চোপড় পরতেন।
ঐ গল্পে বর্ণিত সময়ের অনেক পরে তাকেযখন দেখি তখন মনে হল, কথা সত্য। রংচঙে পোশাক পরার এই ঝোঁক তারশেষ বয়স পর্যন্ত ছিল। তো, আমি তারকথারও প্রেমে পড়েছিলাম। সাহিত্যের পুরা ইতিহাসের উপর বিলক্ষণ অধিকারের একটা অকথিত ইশারা তারসমস্ত উচ্চারণে এমনভাবে প্রকাশিত হত যে, একটা প্রত্যয়জাত বাড়তি সৌন্দর্য বক্তৃতা থেকে ঠিকরে পড়ত। লম্বা চুলগুলা হাতের বাহারি ভঙ্গিতে একবার কাঁধের বামে আরেকবার ডানে চারিয়ে দেয়ার অভ্যাস ছিল তার। আমার ভালো লাগত সেই ভঙ্গিটাও। হতে পারে মান্নান আমার কাঁচা বয়সের আবেগটা কোনোভাবে শুষে নিতে পেরেছিলেন বলেই এতটা আকর্ষণের উৎস হয়ে উঠেছিলেন। হয়ত মান্নান এত আকর্ষণীয় নন। আমি নিজেও এর প্রমাণ পেয়েছি।
শিল্পকলা একাডেমির এক সেমিনার হলে একবার গিয়েছিলাম ‘ব্র্যান্ড’ নাটকের উদ্বোধনী শো দেখতে। শুরুতে আলোচনা। দেখলাম মান্নান সৈয়দও আছেন আলোচকদের মধ্যে। আমার একটু অন্য রকমের আগ্রহ হল। অনেকদিন তারকথা শুনি না। মনোযোগ দিয়ে লেখাও পড়ি না। আবেগ বোধ করি না। দেখি, এখন তারবক্তৃতা কেমন লাগে। তো, তারবক্তৃতা শুনে হতাশ হয়েছিলাম খুব। তাকেসভার সাদামাটা বক্তাদের মধ্যেও বেশ পলকা লাগছিল। দেখলাম, ইবসেনের উপর তারতেমন কিছু বলার নাই। কথার পুরানা ঝাঁজও আর অবশিষ্ট নাই। আমার মায়া লাগল।
কেবল তারজন্য নয়, আমার নিজের জন্যও বটে। তাহলে মান্নানের প্রতি আমার এককালীন পক্ষপাত কি কেবলই প্রথম যৌবনের আবেগ? অনভিজ্ঞ তরুণের মূল্যহীন শ্রদ্ধাঞ্জলি? না। এরকম সিদ্ধান্ত কখনো নিতে হয়নি। এখন আমার মোটামুটি বয়স হয়েছে। শিল্পসাহিত্য সম্পর্কে আমার বর্তমান ধারণা মান্নানের ধারণার প্রায় বিপরীত। তারপ্রতি আমার এককালীন আবেগের স্মৃতিটাই কেবল বাকি আছে। কিন্তু এখনো সবসময় মনে হয় : আবদুল মান্নান সৈয়দ ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যিকই কেবল নন, শিল্পসাহিত্যের জগতে ক্যারিশমেটিক ব্যক্তিত্বও বটে।
দুই
আমাকে অবাক করত তারসৃষ্টিশীলতার প্রাচুর্য। কী বিপুল শ্রম, সময়, মেধা যে তিনি লেখার কাজে লাগিয়েছিলেন, তা আমার মতো অলস-অল্পপ্রাণ সাহিত্যকর্মীর পক্ষে বুঝি ভাবাও কঠিন। বিস্মিত হতাম ফি হপ্তায় তারলেখা পেয়ে। একই সাথে এত বিচিত্র ধরনের লেখার ক্ষমতার কথা ভেবে। কোথায় পেতেন এত উৎসাহ-উদ্দীপনা?
এটা ঠিক, সাহিত্য করে সাহিত্যিক মহলে এবং তরুণতর লিখিয়েদের কাছে মান্নান যথেষ্টসমাদর পেয়েছিলেন। কিন্তু যাকে বলে জাগতিক উন্নতি, একটা বয়সের পর ‘এতকাল সাহিত্য করে কী পেলাম’ গোছের কথাবার্তা বলে আমাদের সাহিত্যিকদের অধিকাংশই যে দিকে ধেয়ে যান, সে লাইনে মান্নান খুব একটা সুবিধা করতে পেরেছিলেন বলে মনে হয় না। মান্নানের লিপ্ততাকে বিরল প্রজাতির সাহিত্যপ্রেম দিয়েই কেবল ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। সাহিত্যপ্রেম জিনিসটা খুব ভালো, এবং কারো মধ্যে এটা থাকা খুব উচ্চপ্রজাতির গুণ নির্দেশ করে – এমন কোনো অনুমান থেকে কথা বলছি না।
শুধু বলছি, মান্নান সৈয়দ সারাজীবন সাহিত্যের ঘোরের মধ্যে ডুবে থাকতে পেরেছিলেন। সৃষ্টিশীলতার পাশাপাশি এই ডুবে থাকাটাই তারবিপুল রচনার উৎস। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত মান্নান সৈয়দ ছিলেন তীব্রভাবে উৎপাদনশীল।
শেষদিকে লিখছিলেন পত্র-প্রবন্ধের ধাঁচে লেখা এক ধরনের মিশ্র গদ্য। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, কল্পনা, সমালোচনা মিলিয়ে সে লেখাগুলোও বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসকেই বারবার নির্মাণ-পুনর্নির্মাণ করে যাচ্ছিল। যখন তারমৃত্যু-সংবাদ পেলাম, তখন ঘটনাক্রমে বিনয় মজুমদারকে নিয়ে তারএকটি লেখা পড়ছিলাম। প্রচুর ব্যক্তিগত আবেগ-অনুভূতির প্যাঁচালের মধ্যেও সে লেখায় ক্রমে পষ্ট হয়ে উঠছিল বিনয় মজুমদার নামের এক কবি, যে কিনা লিখেছে আধুনিক বাংলা কবিতার ধারাবাহিকতার মধ্যে নিজের বিশিষ্টতায়। বিনয়ের আর্থ-সামাজিক প্রতিবেশটা সেখানে ছিল না।
ছিল না আরো অনেক কিছু, যা অন্য অনেকের লেখায় থাকে। কিন্তু, ঐ যে বললাম, আধুনিক জমানার বাংলা কবিতার ইতিহাস, এবং তার ধারাবাহিকতার মধ্যে একজন কবির যথাসম্ভব যথাযোগ্য স্থাননির্দেশ – তা যথেষ্ট পরিমাণে ছিল। ঠিক এ জায়গাটা ছিল সেই প্রথম যৌবনে মান্নানের সমালোচকি লেখালেখির প্রতি আমার আকর্ষণের প্রধান কারণ। মান্নান সৈয়দের মৃত্যুর পর পাবলিক লাইব্রেরিতে তরুণ সাহিত্যিকরা যে আলোচনা-অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল, তাতে অনেক আলোচক তারসমালোচনা-প্রবন্ধের এই বৈশিষ্ট্যের উল্লেখ করেছিলেন। চোখে পড়ার মতো বৈশিষ্ট্য। যাকে আমরা আধুনিক বাংলা সাহিত্য বলে সম্মান ও সমীহ করে থাকি,
তাতে মান্নানের বিলক্ষণ অধিকার ছিল। অন্তত চল্লিশের দশক পর্যন্ত কলকাতার সাহিত্যকর্ম এবং আশির দশক পর্যন্ত ঢাকার সাহিত্যকর্মে তারদখল ছিল ঈর্ষণীয়। তারযে কোনো লেখায় তিনি এর ছাপ রাখতে জানতেন। বলা দরকার, এই ছাপ বাইরের বা আলঙ্কারিক উপাদান হয়ে আসেনি। এসেছে লেখার মর্মবস্তু আকারেই। তিনি আসলে তৈরি করতেন ম্যাপ। সাহিত্যের মানচিত্র। তারপর বা সাথেসাথেই আলোচ্য সাহিত্যিককে এঁকে দিতেন সেই মানচিত্রে। সেই অনতিতরুণ বয়সে সাহিত্যজগত সম্পর্কে আমার চেতনায় পয়লা ছবিটি মান্নানের লেখা পড়েই তৈরি হয়েছিল। অনুমান করি – অনুমানই বা বলি কেন – টের পাই, আরো অনেকে উঠতি যৌবনে পড়েছিলেন মান্নানের খপ্পরে।
আমাকে আরো আকর্ষণ করেছিল তারআমূল সৃষ্টিশীলতা। এ সম্পর্কে পরে একবার বলব। আপাতত বলি তারবই আর প্রবন্ধ-গল্পের নামের কথা। কী সব নাম! ‘জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ’, ‘সত্যের মতো বদমাশ’, ‘মৃত্যুর অধিক লাল ক্ষুধা’, ‘করতলে মহাদেশ’, ‘দশ দিগন্তের দ্রষ্টা’, ‘দরোজার পর দরোজা’, ‘কালো সূর্যের নিচে বহ্ন্যুৎসব’, ‘মাতৃহননের নান্দীপাঠ’ ইত্যাদি আরো কত কী! আমার সে সময়ের অনুভূতি ছিল বিস্ময়ের। এসব নাম আর শব্দ আমার অভিজ্ঞতার মধ্যে ছিল না। কল্পনার সীমায়ও নয়। আজকাল অবশ্য বিস্ময়ের বদলে ঈর্ষা হয়। যখন নিজের লেখার জন্য একটা কাজ-চলতি শিরোনাম হাতড়িয়ে মরি, তখন মান্নানের কথা মনে পড়ে। তাকেএড়াতে পারি না।
তিন
আবদুল মান্নান সৈয়দকে এড়িয়ে আরো বহু দিন আধুনিক বাংলা সাহিত্যের আলোচনা সম্ভব হবে না। সৃজনশীল সাহিত্যে এত এত কাজ করে রেখেছেন তিনি, মেরে-কেটে হিসাব করলেও তার তালিকাটা ইয়া বড় হতে বাধ্য। কয়েকটা উপন্যাস লিখেছেন। বেশ কিছু। আমার ধারণা, তারউপন্যাস হয় নাই। মানে ভালো হয় নাই। তারপ্রতিভা ঠিক ঔপন্যাসিকের প্রতিভা ছিল না। বড় আকারের কাহিনি দাঁড় করানোর মতো ছিল না। সে চেষ্টাও করেননি। ছোট পরিসরের মধ্যে কিছু মজার কাজ আছে। এ মুহূর্তে মনে পড়ছে ‘শ্রাবস্তীর দিনরাত্রি’ নামের এক নভেলার কথা। সংক্ষিপ্ত কিন্তু তীব্র রচনা। তৎসমবহুল গতিশীল গদ্যে বিলাস-ব্যসন আর যৌনতার বর্ণনায় প্রাচীন ভারতের এক বিশিষ্ট ঐতিহাসিক পটভূমিতে সত্যের জয় ঘোষণার কাজটি ভালোই জমেছে। কথাগুলো অনেকদিন আগে পড়ার স্মৃতি থেকে লিখলাম। এ ধরনের কাজ হয়ত আরো কিছু আছে। কিন্তু মান্নান সৈয়দকে ঔপন্যাসিক হিসাবে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়নি কখনো। কোনো অর্থেই। তারনাট্যগুচ্ছ কখনো মঞ্চস্থ হলে সেগুলোর নতুনতর সম্ভাবনা দেখা দিলেও দিতে পারে। আপাতত আমি এই নাটিকাগুলোকে কবিত্বের বিকল্প উৎসারণ হিসাবে ভাবতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি। কিন্তু কবিতা আর ছোটগল্প – এ দুই মাধ্যমে মান্নানের কাজ সাধারণভাবে বাংলা সাহিত্যের এবং বিশেষভাবে বাংলাদেশের সাহিত্যের আয়তনে বিচারের প্রায় যে কোনো মাপকাঠিতেই গুরুত্বপূর্ণ।
গুরুত্বের কতগুলা জাহিরি কারণ আগে বলে নিই, পরে বাতেনিটা বাতলানো যাবে। প্রথমত, মান্নান লম্বা সময় ধরে বিস্তর লেখালেখি করেছেন। সাহিত্যিক মহলে তারখ্যাতি ছিল, প্রভাব-প্রতিপত্তি ছিল। স্বভাবতই প্রভাবিত হয়ে এবং প্রভাবিত করে সমকালীন কবিতা ও গল্পের ধারায় একটা পারস্পরিকতা তৈরি হয়েছিল। তিনি বাংলাদেশের সাহিত্যের রূপ-স্বরূপ ও ধারাবাহিকতার অঙ্গ হয়েছিলেন। দ্বিতীয়ত, বহু গৌণ-অনুল্লেখ্য লেখা লিখলেও তার ‘ভালো’ রচনার পরিমাণ অন্য অনেক লেখকের চেয়ে বেশি। তৃতীয়ত, সাহিত্যের আঙ্গিক নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষায় তিনি বরাবরই আগ্রহী ছিলেন। তারঅতি বড় শত্রুও এ ব্যাপারে সহমত পোষণ করবেন বলে আশা করা যায়। আসলে সাহিত্যের প্রগতি বলতে তিনি এই পরীক্ষা-নিরীক্ষাকেই বুঝতেন। যেমন, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ব্যাপারে বারবার লিখেছেন, ওয়ালীউল্লাহর ব্যর্থ রচনাও মূল্যবান; কারণ, তিনি বরাবরই নিরীক্ষাপ্রবণ বলে পরবর্তী সাহিত্যধারার জন্য তা সবসময়ই নতুন ইশারা রেখে গেছে। কথাগুলো মান্নান সৈয়দের ক্ষেত্রেও সত্য। চতুর্থত, মান্নান বেশ কিছু রীতি বা ধারা কবিতা ও গল্পে নিয়ে এসে ঢাকার সাহিত্যমহলকে হতচকিত করেছেন। আজ চার/পাঁচ দশক পরে এগুলো হয়ত তত তাজা মনে হবে না। কিন্তু ষাটের গোড়ায় যখন এসব লেখার কোনো কোনোটি অবিরল সহজতায় বের হচ্ছিল, তখন তার নতুনতা খুব উল্লেখযোগ্য বলেই মনে হয়েছিল। তখনকার এবং পরেকার বহু আলোচনা-সমালোচনায় সেই স্বীকৃতি পাওয়া যায়।
এবার আসা যাক বাতেনি কারণগুলোতে। এগুলোকে বাতেনি বলার অর্থ এই নয় যে এগুলা পাঠকের চোখ এড়িয়ে যায় বা যাবে। আসলে সম্ভবত বেশির ভাগ পাঠক মান্নানের গল্পে-কবিতায় এগুলোই পড়েন। এগুলো ভিতরের বৈশিষ্ট্য। মান্নানের শিল্পীসত্তার প্রধান অবলম্বন। অন্তত আমার তাই মনে হয়।
মান্নান তারলেখায় আমদানি করেছেন একরাশ অপরিচিত উপাদান। ঢাকার সাহিত্যে এ বস্তু ছিল খুবই বিরল। তারকবিতায় অব্যবহিত প্রাত্যহিকতার বদলে পাই দূরবর্তী বস্তুজগত। যেখানে খুব দূরবর্তী নয়, সেখানেও অপরিচিতির হরেক রকম রং-রূপ মেখে রহস্যময় সুদূরতার আবেশ তৈরি করেছেন তিনি। অন্তত প্রথম দিকে, অনেকদিন। গল্পের ক্ষেত্রেও অন্তর্জগতের মিঠাকড়া বা ধূসর আবহ তৈরি করতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন তিনি। ফলে পরিচিত মাঠঘাট আর ইটপাথর-গাছগাছালির মধ্য দিয়ে গেলেও তারলেখা পাঠককে নিয়ে যায় এক অচেনা জগতে। যাকে আমরা হরহামেশাই শিল্পীর নিজস্ব জগত বলি, মান্নানের ক্ষেত্রে সে জগতটি খুব ব্যক্তিগত আর বিশিষ্টই কেবল নয়, বিস্ময়করভাবে নতুনও বটে। আমরা যে আগে বলেছি, তারপ্রতিভা ঠিক ঔপন্যাসিকের প্রতিভা নয়, তার মূল কারণ এটাই। পরিচিত দিনযাপন আর ঘটনাপ্রবাহের ঋণ না নিয়ে উপন্যাসের বড় পরিসর তৈরি করা তো সম্ভব নয়। কিন্তু কবিতা আর গল্পের ছোট্ট পরিসর সম্ভব। অন্তত মাঝ বয়স পর্যন্ত মান্নান অত্যন্ত সাফল্যের সাথে এ কাজটি করতে পেরেছেন। ফর্মালিস্টরা যে অর্থে ও যে ভাবে অপরিচিতকরণকে শিল্পের প্রধান গুণ হিসাবে দেখতেন, সেই বাটখারায় মাপলে বাংলাদেশের সাহিত্যে তারস্থান হবে অনেক উঁচুতে।
এ প্রসঙ্গেই বলতে হয় কল্পনাপ্রতিভার কথা। আমাদের শিল্পসাহিত্যের অঙ্গনে এ বস্তুর উচ্চ মহিমা জাহির আছে। আমার প্রায়ই মনে হয়, এই মহিমা ঔপনিবেশিক আমলের অভিজ্ঞতার সাথে যুক্ত। সেকালে রোমান্টিসিজম, অতীতপ্রীতি, রোমান্স ইত্যাদির ব্যাপক আদর-কদরের মধ্যে বর্তমানকে পাশ কাটিয়ে যাবার একটা চেতন-অচেতন ঝোঁক বোধ হয় কাজ করে গেছে। পরবর্তীকালেও যাপিত জীবনের তুলনায় কল্পিত জীবনকে মহিমান্বিত করার রেওয়াজ আমাদের সাহিত্যাঙ্গনে খুবই সুলভ।
এ সব কথা মাথায় রেখেও বলা যায়, শিল্পসাহিত্যের সাথে কল্পনাপ্রতিভার একটা গোড়ার যোগ আছে। সম্ভাব্যকে হাজির করা, আকর্ষণীয় রূপকল্প তৈয়ার করা, নিজস্ব জগত গড়ে তোলা – এসব যেহেতু সাহিত্যের গোড়ার জরুরত, সেহেতু কল্পনার গীত না গেয়ে উপায় নাই। মান্নানের ক্ষেত্রে এর একটা বাড়তি দরকার বোধ হয় ছিল।
একথা বলছি দূরবর্তী এক অনুমান থেকে। আর এ ক্ষেত্রে শওকত ওসমানের উদাহরণ আমাকে প্ররোচিত করছে। শওকতের প্রথম উপন্যাস ‘জননী’ তারগ্রামের অভিজ্ঞতা নিয়ে বিশুদ্ধ বাস্তববাদী ভঙ্গিতে লেখা। ঢাকায় হিজরত করার পর এ ধরনের লেখা কিন্তু তিনি আর লিখতে পারেননি বা লেখেননি। তখন তারঅবলম্বন হয়েছে রূপকের জগত। নতুন জীবনের অভিজ্ঞতার সাথে একাত্ম হতে না পারাই হয়ত তারবহু লেখার বেখাপ্পা বয়ানরীতির উৎস।
মান্নানের লেখায় ঢাকার পারিবারিক-সামাজিক জীবনের অপ্রতুলতার কারণ কি ঐ একই ইতিহাস? নিশ্চয় করে বলা কঠিন। তবে এটুকু বলা বোধ হয় অসঙ্গত হবে না, তারলেখায় বাস্তব অভিজ্ঞতার ঘাটতি আছে। এই ঘাটতি তিনি পুষিয়ে নিয়েছিলেন কল্পনাপ্রতিভায় ভর দিয়ে। শুধু ঘাটতিই পূরণ করেননি, অজস্র ফুলও ফুটিয়েছেন। তারলেখায় রাস্তা, দোকান, পুলিশ সব কিছুকে একসাথে নক্ষত্র হয়ে উড়ে যেতে দেখে; কিংবা দোকানদার খরিদ্দারের মুণ্ডু কেটে নেয়ার পর টপাটপ রক্ত ঝরতে দেখে; কিংবা তিন স্তনের রমণীকে তেড়ে আসতে দেখে; কিংবা বোধবোধিকে মাছ হয়ে একুরিয়ামে বা রাস্তায় ঘুরাঘুরি করতে দেখে আমাদের কল্পনার পালেও হাওয়া লাগে।
আমরাও কালবিলম্ব না করে বেরিয়ে পড়ি তারসাথে, তারবর্ণবিপুল কিন্তু অপরিচয়ের কুয়াশায় ঘোর-লাগা অচিন দেশে। দেখাতেই চেয়েছেন মান্নান; এঁকেছেন অসংখ্য অভাবিত ছবি। এসব ছবি আমাদের বাইরের চোখের হর্ষোৎফুল্ল সম্মতি আদায় করে মনের চোখে টুংটাং ভাসতে থাকলে বুঝি : কল্পনার অনাচার এ নয়, বরং জীবনানন্দকে উদ্ধৃত করে বহুবার মান্নান নিজে যে শব্দ ব্যবহার করেছেন, এ হল সেই ‘প্রকল্পনা’।
আমার আন্দাজ, এই কল্পনার তেজ কমে যাওয়ায় মান্নান সৈয়দের দ্বিতীয়ার্ধের কবিতা-গল্প অনেকটা সাদামাটা বয়ানে নেমে গেছে। কল্পনার জোর ছাড়াও লেখকদের হাতে অনেক ধনরত্ন থাকে। তিনি সেসব লাইনেও কিছু হেঁটেছেন। কিন্তু খুব সুবিধা করতে পেরেছেন বলে মনে হয় না। টানা গদ্য আর চিত্রকল্পের মিছিল ছেড়ে অনেকবার গেছেন ছন্দ-মিলে। ‘সকল প্রশংসা তার’ এবং ‘নীরবতা গভীরতা দুই বোন বলে কথা’ বই দুটোতে হাজির হয়েছেন অন্য রকম ভাব আর ভঙ্গি নিয়ে। কিন্তু কোনো তুরীয় লোকে পৌঁছেছেন বলে মনে হয়নি। গল্পের ক্ষেত্রেও ঢাকার নাগরিক জীবনের প্রাত্যহিক বাস্তবতা নিয়ে লেখা তারবহু রচনা কখনো কখনো এমনকি পুরানা জৌলুশের স্মৃতিও জাগায়নি।
এ দিক থেকে তাৎক্ষণিক দরকারে মান্নান সৈয়দের কবিতা-গল্পকে ভাগ করতে চাই দুই ভাগে। এক ভাগ কল্পনাপ্রবণ সৃষ্টিশীলতায় মুখর, আরেকভাগ কবিতার ক্ষেত্রে গেছে কিছু ব্যক্তিগত ও আধ্যাত্মিক বোঝাপড়ার দিকে, আর গল্পের ক্ষেত্রে গেছে দিনযাপনের বাস্তবতায়। এর মধ্যে প্রথমটিই মান্নানীয় এবং মূল্যবান। এ মন্তব্য করার সময় বারবার মনে পড়ছে সমালোচক আবদুল মান্নান সৈয়দকে, যিনি সাহিত্যিককে সামগ্রিকভাবে পড়ার উপর জোর দিতেন। জানি, তারএ পদ্ধতি কোথাও কোথাও খুবই কাজের হয়েছে। তবু আমরা এখানে তারমূল্যায়নের ক্ষেত্রে সমগ্রের বদলে বেছে নিলাম প্রথমাংশ।
মান্নানের সৃষ্টিশীল সাহিত্যকর্মের আরেক বড় বৈশিষ্ট্য ব্যক্তিভজনা। তারকেন্দ্রীয় চরিত্র ‘আমি’ – প্রায় আক্ষরিক অর্থেই ব্যক্তি-লেখক। কোনো কোনো লেখকের ‘আমি’ দশের ভাব-স্বভাব চুরি করে হয়ে ওঠে সমষ্টির আয়না। কখনো কখনো ব্যক্তি তেজে-প্রভায়-বৈভবে দশকে ছাড়িয়ে গেলেও প্রভাবশালী হয়ে জড়িয়ে থাকে দশেরই সাথে।
মান্নানের ক্ষেত্রে এর কোনোটাই হয় নাই। বরং তিনি যখন কবিতা লিখেছেন একুশে ফেব্রুয়ারি নিয়ে, কিংবা গল্প লিখেছেন দাঙ্গার মতো সামষ্টিকতা নিয়ে, তখনো ভিড়ভাট্টা ঠেলে একজনই বেরিয়ে এসেছে ইচ্ছা-প্রবৃত্তি বা আবেগ-অনুভূতি সমেত। এ দিক থেকে মান্নান ঢাকার সাহিত্যের প্রধান প্রবণতা থেকে পৃথক। তারচরিত্রগুলো প্রায়ই বিচ্ছিন্ন। অনেকের সামাজিক সংশ্রব তো দূরের কথা, পারিবারিক বন্ধনও নাই। তাদের অনেকেই রুগ্ন, অব্যবস্থিত, প্রবৃত্তিচালিত, প্রবৃত্তিকাতর। এ ধরনের সম্পর্ক ও দায়দায়িত্বহীন ব্যক্তি শেষ পর্যন্ত – সাহিত্যিক অর্থেই – কতটা কাজের, সে প্রশ্ন উঠতে পারে।
উঠাই উচিৎ। কিন্তু এ প্রশ্ন মুলতুবি রেখে যদি এগিয়ে যাই গল্প পর্যন্ত, যদি মনে করি যে, সাহিত্যের ধারাক্রমের মধ্যে গল্প হয়ে ওঠাটাই মূল কথা,
তাহলে হলফ করে বলা যায় : বিশুদ্ধ ব্যক্তিনির্ভর গল্প লেখার ক্ষেত্রে মান্নান সৈয়দ বাংলাদেশের সাহিত্যে একেবারেই অনন্য। ‘সত্যের মতো বদমাশ’ পড়ার অভিজ্ঞতার কথা মনে পড়ে। মনে আছে, ‘মাতৃহননের নান্দীপাঠ’ গল্পে ঐ একজনই যে চায়ের দোকানে টেবিলের দুপাশে দুভাগ হয়ে বসে কথা কাটাকাটি করছে, এটা বুঝতে বেশ সময় লেগেছিল। আমোদ পেয়েছিলাম অন্তর্লীন সংলাপে নিষ্পন্ন এই গল্পটির শরীরী প্রতিভা আবিষ্কার করে। ‘চাবি’ গল্পের অনুসন্ধানকে বেশ মূল্যবান মনে হয়েছিল, আর নানান ঘরের বাররকম মানুষের মধ্যে ঐ লোকটির অস্থির একাকিত্ব কেমন কেটে কেটে বসে যাচ্ছিল বুকের মাঝ বরাবর।
বিস্ময় মেনেছিলাম কিছু পরে লেখা ‘রাস্তা’ গল্প পড়ে – গল্পটির চিক্কন শরীর আর ততোধিক সূক্ষ্ম থিমে। এ ধরনের কিছু গল্প পড়েই একবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম : সৈয়দ শামসুল হক আর শহীদুল জহিরের মতো আবদুল মান্নান সৈয়দও লিখেছেন ‘গল্পের জন্য গল্প’। অর্থাৎ, অন্য কোনো কিছু দেখানোর বা বুঝানোর জন্য নয়, স্রেফ গল্পের একটা কাঠামো বা শরীর তৈরির খায়েশ থেকেই এ গল্পগুলো লেখা হয়েছে। মান্নানের সাথে অবশ্য এ দুজনের অমিলই বেশি।
যাই হোক, বলছিলাম মান্নানের গল্পের ব্যক্তি-নির্ভরতার কথা। ব্যক্তির ইচ্ছা, সুখ-দুখ, পলায়নপরতা আর কল্পনাকে প্রশ্রয় দিয়েছেন বলে নতুন অনেক টেকনিক বা আইডিয়াও পাওয়া গেছে তারগল্পে। পুরানা প্রেমিকার সাথে গপসপ করতে গিয়ে প্রেমিকার স্বামীর হাতে নাকাল হওয়ার পর তারপ্রেমিকপুরুষটি সম্মুখ লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয় না; বরং ডুব দেয় লেকের পানিতে।
না, মরতে নয়; লেকে প্রেমিকার বাড়ির যে ছায়া পড়েছে, সেই ছায়া-বাড়িতে প্রেমিকার সাথে নিভৃতে মিলিত হতে। অন্য এক গল্পে চিত্রকর মশায় ভেজাল এড়াতে সটান ঢুকে পড়ে নিজের এক শিল্পকর্মে, যেখানে এক চালু ট্রেন নিঃশব্দে চলছিল পলায়নের বাহন হয়ে। আরেক গল্পে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ঘনিয়ে ওঠা চাপা অসন্তোষকে আকার দিতে হাজির হয় ঝাঁক ঝাঁক মাছি। বাইরের সক্রিয়তা বা সম্পর্কের তুলনায় অন্তর্জগতের তুলনামূলকভাবে অচেনা আকুলিবিকুলিকে অবয়ব দিতে চেয়েছেন বলে তাকেএসব – এক-অর্থে আজগুবি – কৌশল আমদানি করতে হয়েছে। তবে এই ব্যক্তিনির্ভরতার সবচেয়ে ভালো ফল ফলেছে তারগল্পের কাঠামো বা অবয়বে।